তুরস্কে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ছাড়ালো ১৬ হাজার The Daily Sylhet The Daily Sylhet প্রকাশিত: ৫:৫০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩ তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গাজিয়ানতেপে সিরিয়া সীমান্তের কাছে প্রবল ভূমিকম্পের আঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে। কম্পন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তা টের পাওয়া গেছে ইসরায়েল, সাইপ্রাস- এমনকি সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত গ্রিনল্যান্ড থেকেও। বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ১২ হাজার ৮৭৩। আর সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্ধার হওয়া মরদেহের সংখ্যা ৩ হাজার ১৬২টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মৃতের এই সংখ্যা ২০ হাজারে পৌঁছাতে পারে। এর আগে ১৯৯৯ সালে একই অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ সহস্রাধিক বেসামরিক লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। জানা যায়, প্রথম ভূমিকম্পের ১২ ঘণ্টা না যেতেই ফের ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে তুরস্ক। একই সঙ্গে সিরিয়াতেও এ ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে। পর পর দুইবারের ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কে ৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সিরিয়াতেও সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে দুই দেশে দেখা দিয়েছে ভয়ারহ মানবিক বিপর্যয়। তুরস্কে ও সিরিয়ায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। ধসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজারো মানুষ আটকা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় তুরস্ক ৩ মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। দেশজুড়ে ঘোষণা করা হয়েছে এক সপ্তাহের শোক। বন্ধ ঘোষিত হয়েছে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ শহর ও প্রদেশের সব স্কুল-কলেজ।দেশটিতে ৮৪ বছরের মধ্যে এত শক্তিশালী ভূমিকম্প আর দেখা যায়নি। এই ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ে তুরস্ক ও সিরিয়ার প্রতি শোক সমবেদনা জানিয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশের নেতানেত্রীরা। খবর বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, আলজাজিরা, এএফপি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও ডেইলি সাবাহের। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারাসহ দেশটির অন্যান্য শহরে এবং পার্শ্ববর্তী সিরিয়াসহ প্রতিবেশী দেশ লেবানন, সাইপ্রাস, ইসরায়েলেও এই ভূকম্পন অনুভূত হয়। এরপর কয়েকবার পরাঘাত আঘাত হানে। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল ৬ দশমিক ৪ ও একটি ৬ দশমিক ৫ মাত্রার। তুরস্কে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলো কাহরামানমারাস, গাজিয়ানতেপ, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির, আদানা, আদিয়ামান, মালত্য, ওসমানিয়ে, হাতায় ও কিলিস। আর সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব, হামা ও লাতাকিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের আজাজ শহরে গোলাম সাঈদ রিংকুসহ দুই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল মোহাম্মেদ নুর-আলম। ভূমিকম্পের পরপরই জোর উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে তুরস্কা ও সিরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ, দমকল বাহিনী ও সাধারণ মানুষ। তবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, শীতকালীন তুষারঝড় ও বৃষ্টির কারণে উদ্ধার কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। তুষারে অনেক সড়ক ঢেকে গেছে। শীতের এই ভয়াবহ ঠাণ্ডায় সেখানকার পরিস্থিতিকে মারাত্মক জটিল করে তুলেছে। বর্তমানে ভূমিকম্প কবলিত তুরস্কের গাজিয়ানতেপের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশের কিলিসের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি। ওসমানিয়ার তাপমাত্রা মাইনাস ২ ডিগ্রি। সিরিয়ার তাপমাত্রাও এর কাছাকাছি। সঙ্গে আছে তুষারপাত, বৃষ্টি। ফলে সোমবার ভূমিকম্পের পর যারা বেঁচে আছেন, তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। উদ্ধারকর্মীদের জন্য এ এক কঠিন অবস্থা। এটা সবার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের দিয়ারবাকির শহরে বিপুল সংখ্যক উদ্ধারকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক ধ্বংসস্তূপের ভিতর উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পরনে জ্যাকেট। তুষারপাত হওয়ার কারণে পরেছেন ‘ফেস স্কার্ফ’। এদিকে তীব্র শক্তিশালী ঝড় আঘাত করেছে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে। ভয়ানক ঠাণ্ডা। বহু মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছেন। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে। এ সংকট সহজেই সমাধান হওয়ার নয়। ফলে চরম ভয়াবহ ও আতঙ্কসৃষ্টিকারী হয়ে ওঠেছে এই ভূমিকম্প। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাই বলেছেন, চরমভাবাপন্ন পরিবেশের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ লড়াই করছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা দুর্গতদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। এদিকে সন্ধ্যার আগে আসা খবর অনুযায়ী তুরস্কের বিভিন্ন এলাকায় মৃতের সংখ্যা, কাহরামানমারাসে ১৯১, গাজিয়ানটেপে ২০০, সেনলুর্ফায় ২৭, আদানায় ৪৩, আদিয়ামানে ২০, ওসমানিয়েতে ১৩১, হাতায়ে ২৫০, কিলিসে ১৩ ও মালাত্যায় ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। ভূমিকম্পের তীব্রতায় ১০২টি বহুতল ভবন একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও সহস্রাধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতেই জানিয়েছেন, তুরস্কে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১২ হাজার ৮৭৩ জন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ২৭ হাজার। উদ্ধারকাজে নামানো হয়েছে এয়ারক্রাফট। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। তাছাড়া দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। ভূমিকম্পের পর সহমর্মিতা জানাতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ফোন করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি আশ্বাস দেন, এই বিপর্যয়কর মুহূর্তে যে কোনো ধরণের সহযোগিতার জন্য রাশিয়া প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া সঙ্গে সঙ্গেই দুটি আইএল-৭৬ বিমানকে সিরিয়ায় পাঠিয়েছে মস্কো। এগুলো উদ্ধারকার্যে সিরিয়ার বাহিনীকে সাহায্য করবে। এছাড়া সিরিয়ায় শান্তিরক্ষায় নিয়োযিত রুশ সেনারা এরইমধ্যে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে। ভূমিকম্প আঘাত হানা অঞ্চলে জরুরি উদ্ধারকার্য পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সোমবার সকালেই তিনি মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। সিরিয়ার সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা হচ্ছে আলেপ্পো, হামা এবং লাটাকিয়া প্রদেশ। উদ্ধার অভিযান ও মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সিভিল ডিফেন্স, দমকল, স্বাস্থ্য, পাবলিক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং তাদের শাখাগুলোকে নিয়োযিত করেছে সিরিয়া সরকার। তুরস্কে সবথেকে বেশি প্রাণহানী হয়েছে মালাতিয়া প্রদেশে। এছাড়া দিয়ারবাকির এবং ওসমানিয়ে প্রদেশেও বহু হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তুরস্কে একটি শপিংমল ধসে পড়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই দীর্ঘ সময় ধরে কম্পন অনুভূত হয়। সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস ভূমিকম্পের আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা গেছে একাধিক বহুতল ভেঙে পড়েছে। একাধিক বাড়ি ভেঙে পড়ার ছবি দেখা গেছে। এদিকে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, লেবাননের রাজধানী বৈরুত ও বন্দর শহর ত্রিপোলিতে ভূমিকম্পের কারণে লোকজন দৌঁড়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়, তাদের ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে আশঙ্কায় কেউ কেউ নিজেদের গাড়ি সেখান থেকে সরিয়ে নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল তুরস্কের গাজিয়ানটেপ প্রদেশের নুরদাগি শহরের পূর্বাঞ্চলে। ভূ-কম্পনটির উৎপত্তিস্থলে গভীরতা ছিল ২৪ দশমিক ১ কিলোমিটার। জায়গাটি নুরদাগি থেকে ২৩ কিমি পূর্বে অবস্থিত। গাজিয়ান্তেপের গভর্নর দাভুত গুল টুইটারে বলেছেন, শহরে ভূমিকম্পটি প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছে। জনসাধারণকে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করার ও শান্ত থাকার পরামর্শও দিয়েছেন গভর্নর দাভুত গুল। তুরস্কের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলেও শক্তিশালী আফটারশক অনুভূত হয়েছে। মূল ভূ-কম্পনটি আঘাত হানার প্রায় ১১ মিনিট পর আরেক দফায় আঘাত হানে ভূমিকম্প। ৬ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী আফটারশক মূল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আঘাত হানে। ১৯ মিনিট পরে, ৫ দশমিক ৬ মাত্রার আরেকটি তীব্র আফটারশক অনুভূত হয়। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সোইলু জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারাস, হতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাটিয়া, সানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস-এই ১০টি শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভয়াবহ এ ঘটনার পরপরই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান টুইটারে বলেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুরোদমে অনুসন্ধান কাজ চলছে, পাঠানো হয়েছে উদ্ধারকারী দল। আমরা যথাশীঘ্রসম্ভব ও কম ক্ষতি হয় সেভাবে কাজ করছি। সবাইকে একসঙ্গে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আশাও ব্যক্ত করেন তিনি। যদিও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে আটটি ক্ষতিগ্রস্ত শহরের গভর্নরদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে তুর্কি শহর গাজিয়ানতেপের বাসিন্দা এরদেম বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে এমন ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হয়নি। আমি বেঁচে আছি কিনা এমন অনুভব করতে পারছিলাম না। আন্তর্জাতিক/আবির SHARES আন্তর্জাতিক বিষয়: